সুনামগঞ্জ , বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫ , ২ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
হাসপাতাল চালুর দাবিতে মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের অনির্দিষ্টকালের ক্লাস বর্জন বর্ণিল আয়োজনে বর্ষবরণ হাওরে চড়ক উৎসবে মানুষের ঢল ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা, দ্রুত পাকা ধান কাটার আহ্বান বন্যার ঝুঁকিতে হাওরাঞ্চল তিন দপ্তরের ছুটি বাতিল গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতায় নিহত বেড়ে ৫১ হাজার, নিখোঁজ ১১০০০ ধর্মপাশায় দুই আসামি গ্রেফতার বিএনপি’র ঈদ পুনর্মিলনী সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ে নববর্ষ উৎসব ডাকসু নির্বাচনের কমিশন গঠন মে মাসে এই সরকারকে ৫ বছর চাওয়ার কথা আমার নয়, জনগণের : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাগর-রুনি হত্যা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় পেছালো ১১৮ বার সুনামগঞ্জ শহরের শৃঙ্খলার জন্য অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা নববর্ষের প্রত্যাশা, বিজন সেন রায় বোরো ধান কাটার ধুম, হাওরে বৈশাখী হাসি আমাদের পহেলা বৈশাখ ছাতকসহ দেশের ১০ অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিকল্পনা বাতিল ফিলিস্তিনে ইসরাইলি হামলার প্রতিবাদে জাতীয় পার্টির বিক্ষোভ

আমাদের পহেলা বৈশাখ

  • আপলোড সময় : ১৪-০৪-২০২৫ ০৮:০৬:৩৭ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১৪-০৪-২০২৫ ০৮:০৬:৩৭ পূর্বাহ্ন
আমাদের পহেলা বৈশাখ
মোহাম্মদ আব্দুল হক:: পহেলা বৈশাখে অতীতের দুঃখ-গ্লানি ধুয়ে-মুছে নতুনভাবে জীবন শুরু করার স্বপ্ন রচনা করেন সবাই। সেই প্রাণাবেগ ধরা পড়ে আমাদের বাংলা নববর্ষ পালনের বহুমাত্রিক আয়োজনে। বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখকে ১৯৭২ খ্রিস্টিয় সালে বঙ্গবন্ধু সরকার জাতীয় পার্বণ ঘোষণা করেন। সারা বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজ। এখানে নানান কারণে ইংলিশ ক্যালেন্ডার গুরুত্বপূর্ণ। ইংলিশ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অফিসিয়াল কাজ ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ চললেও আমাদের সংস্কৃতির তৃষ্ণা জুড়ায় না, আমাদের নাড়ীর তৃপ্তি মিটে না। বাঙালির নাড়ীর ¯পন্দনে বাঙালি সংস্কৃতি বাংলা বারোমাস জুড়ে খেলা করে। তাই বাঙালি বাংলা নববর্ষ পালন করে প্রাণখোলা আনন্দ উচ্ছ্বাসে। বাংলা নববর্ষের প্রথম প্রভাতে পহেলা বৈশাখে বাংলাদেশ ও বাঙালি নানান সাজে সজ্জিত হয়ে নানান রকম অনুষ্ঠানে নতুন বছরকে বরণ করে থাকে সারাদিন। তবে ইতিহাসের ধারাবাহিক খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে বাঙালি সবসময় একইভাবে বর্ষবরণ করেন না। কালে কালে বাঙালির বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতায় পরিবর্তন এসেছে। বাংলা নববর্ষ বরণ ধীরে ধীরে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, বাংলা নববর্ষ উদযাপন বিভিন্ন সময়ে বাঙালি জাতির প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে। আমরা পাই বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পরে পাকিস্তানের আইয়ুব খানের আমল এবং গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছিলো বাংলা নববর্ষ বরণের বহুরকম আনুষ্ঠানিকতা। বাংলা সনের তারিখ আমাদের প্রতিদিনের শিক্ষা-কার্যক্রম ও অফিসিয়াল কাজে ব্যবহৃত হয় না, তাই শিক্ষার্থীসহ অনেকের কাছে বাংলা সন গণনার ইতিহাস অজানা থেকে যায় আবার অনেকে মনে রাখতে পারেন না। তবে বৈশাখ মাস যখন দোরগোড়ায় এসে যায় তখন প্রায় সকলেই বিভিন্ন পত্রিকা বা বিভিন্ন বইয়ের লেখা খোঁজ করে জানতে চেষ্টা করেন। তাই বাংলা সন গণনার ইতিহাস সংক্ষেপে উপস্থাপন করা সময়ের দাবি মনে করছি। ইতিহাস খুঁজে জানা যায়, বাংলায় যখন মোগল সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিলো তখন কৃষক তথা প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হতো হিজরি সন গণনা করে। কিন্তু; হিজরি আরবি সন চন্দ্র মাসের হিসেবে চলে। অথচ আমাদের বাংলায় সেই হিসাব মতে ফসল উৎপাদন হয় না। ফসল ফলানো না-গেলে কৃষক প্রজারা খাজনা দিবে কেমন করে আর স¤্রাটরা নিবেই কি। সেই চিন্তা মাথায় নিয়ে সুষ্ঠু খাজনা ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে মোগল স¤্রাট আকবর চির বাঙালির বাংলায় বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। ফতেহউল্লাহ সিরাজি ছিলেন ওই সময়ের বাংলার বিচক্ষণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং একজন বিখ্যাত চিন্তাবিদ। তিনি মূলত স¤্রাট আকবরের আদেশ অনুযায়ী প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনয়ন করেন সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে। আর এভাবেই আমরা নতুন বাংলা সন পাই। জানা গেছে ১৫৮৪ সালের ১০ই মার্চ অথবা ১১ই মার্চ থেকেই বাংলা সন গণনা শুরু হয়েছিলো। আর প্রকৃত অর্থে বাংলা সনের গণনা কার্যকর করা হয়েছিলো স¤্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকেই। সেটা ছিলো ১৫৫৬ সালের ৫ই নভেম্বর। আমাদের এ সময়ের বাংলা বর্ষ তৎকালীন সময়ে অন্য নামে পরিচিত ছিলো। ফসল ফলানো এবং ফসল ঘরে তোলার উপর গুরুত্ব দিয়েই প্রথম দিকে আমাদের বাংলা সনকে ফসলী সন নামেই বলা হতো। পরে তা বঙ্গাব্দ এবং বাংলা বর্ষ নাম ধারণ করে। আমরা এখন যে বৈশাখী উৎসব পালন করি তা মূলত স¤্রাট আকবরের সময় থেকেই হয়ে আসছে। তখন থেকেই বৈশাখ মাসের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তৎকালীন সময়ে সা¤্রাজ্যের নিয়ম ছিলো চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে কৃষক প্রজাদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে হবে। তারপর নতুন বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজেদের গ্রামের মানুষদেরকে মিষ্টান্ন খাইয়ে সমাদর করতেন। এই ধরনের পরিবেশে বাংলার কৃষকেরা বেশ আনন্দ উপভোগ করতেন শতো কষ্টের মাঝেও। সমাজের মানুষ এ উপলক্ষে বিভিন্ন আনন্দ উৎসবের আয়োজন করতেন। ওই সকল উৎসবই কালক্রমে সারা বাংলায় বাঙালির সামাজিক খুশির অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। বিংশ শতাব্দীতে আমার ছোটোবেলায়ও দেখতে পেতাম বিশেষ করে ব্যবসায়ী সমাজ তাদের দোকানে ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠান আয়োজন করতেন। এখানে বর্তমান ফেসবুক যুগের ছেলেমেয়েদের সহজে ‘হালখাতা’র ধারণা দেয়া যেতে পারে এভাবে, হালখাতা একধরনের নতুন খাতা যার মাধ্যমে ব্যবসায়ীগণ ক্রেতাদের সাথে পুরোনো লেনদেন শেষ করে আনুষ্ঠানিক ভাবে নতুন করে ব্যবসায়িক স¤পর্ক হালনাগাদ করতেন। আমার মনে আছে, তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আমি বাবার সাথে সুনামগঞ্জ শহরের একটি দোকানে যাই। বাবা দোকানের মহাজনকে অনেকগুলো নগদ টাকা দিলেন। মহাজনসাব একটি খাতা বের করে লাল কালিতে পরিশোধ কথাটা লিখলেন এবং আমাদেরকে সুনামগঞ্জের বিখ্যাত ‘দেশবন্ধু মিষ্টিঘর’ থেকে রসগোল্লা ও আমিত্তি আনিয়ে আপ্যায়ন করালেন। এই ধরনের অনুষ্ঠান এখনও ব্যবসায়ী মহলে প্রচলিত আছে। আর জীবন যাপনের ক্ষেত্রে আমাদের কৃষক ভাইরা এখনও বহুরকম সুবিধাবঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও বৈশাখ মাস ঘিরে কৃষকের মনে অনেক স্বপ্ন উঁকি দেয়। বৈশাখ মাসে ঢাকা, রাজশাহী ও বিভিন্ন শহরে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়। বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। বাংলাদেশের বৈশাখের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, খুব ঝড়-তুফান হয় এবং সেই সাথে শিলাবৃষ্টি। অনেক সময় অতিবৃষ্টিতে নানান রকম সবজির বিছরা (বাগান), ধান ফসলের বিল ও হাওর তলিয়ে যায়। সেই সাথে কৃষকের স্বপ্নও অনিশ্চয়তায় পানিতে ভাসে। এভাবে ফসলের ক্ষতির কারণে অনেক পরিবার খাদ্য ঘাটতিতে পড়ে। তখন দ্রব্যমূল্যও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। তাই কৃষক ও সর্বস্তরের জনগণের দাবি সঠিক সময়ে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার যেনো কৃষকের কষ্টে ফলানো হাসি মাখানো ফসল রক্ষার উদ্যোগ নেন। আমরা এখন আগেকার দিনের চেয়ে অনেক বেশি শিখছি। সেই সাথে গ্রাম ও শহরে চলনে-বলনে ও সাজ-পোশাকে এসেছে নতুনত্ব। আগে গ্রামে চৈত্র-বৈশাখ মাসে মেলা হতো। এখন গ্রামেও পহেলা বৈশাখকে ঘিরে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ইত্যাদি বড়ো শহরের ন্যায় অনেকটা মিল রেখে বৈশাখী মেলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেখানে বাঙালি আছেন সেখানেই বৈশাখী মেলা হয় এবং তরুণ-তরুণী শিশু বৃদ্ধ সকলে মিলে কবিতাপাঠ, বাংলা গান, বাঙালি খাবার ইত্যাদি আয়োজনে বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় ফুটিয়ে তুলেন। বাংলা নববর্ষ শুরু হয় সূর্য উদয় হওয়ার সাথে। আমরা সাজি এবং রবীন্দ্রনাথের সাথে বলি- “এসো হে বৈশাখ এসো এসো।” হ্যাঁ, বাঙালির প্রাণের বাংলা নববর্ষের আয়োজনে আমরা সময়ের ভাবনা সংযোজন করবো এবং প্রয়োজনীয় সাজবো। কিন্তু; মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির সুযোগ নিয়ে দুষ্টচক্র যাতে বাঙালি সংস্কৃতিকে কলুষিত করতে না-পারে সেদিকে অবশ্যই ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক-অভিভাবক সকলকে সজাগ থাকতে হবে। বাঙালি হিসেবে আমাদের শিক্ষাসহ সকল অর্জন সার্থক হবে তখনই যদি আমরা পহেলা বৈশাখের উৎসব সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পালন করে ছেলে মেয়ে শিশু বৃদ্ধ সকলে সন্ধ্যায় নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারি। মনে রাখতে হবে বিশ্বে আমরা একজাতি, আমরা বাঙালি, আমরা বাংলাদেশী। আমরা প্রাচীন বাংলার মৃত্তিকার বাঙালির উত্তরসূরী এই বাংলার মাটি ও জলের বাঙালি। স্ব-গৌরবে ছড়িয়ে পড়–ক বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় বিশ্বময়। জয় হোক বাংলার মানুষের। কাজী নজরুল ইসলাম এর সাথে আমরা বলি- “তোরা সব জয়ধ্বনি কর! তোরা সব জয়ধ্বনি কর!! ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়।”

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স